Thursday 14 January 2016

লিখিত প্রস্তুতি : বাংলাদেশ বিষয়াবলি (ভূমিকম্প: উৎপত্তি, কারণ,পরিমাপ, ট্যাকটোনিক প্লেট, ভূমিকম্প জোনে বাংলাদেশের অবস্থান, ঝুঁকি, প্রস্তুতি ও করণীয়) By Samad Azad [Admin, BCS: Our Goal [Largest Job group of Bangladesh]]

=====================
বাংলাদেশে ভূমিকম্প: ঝুঁকি, প্রস্তুতি ও করণীয়
=====================
.
---------------------------------
★ ভূমিকম্প কী?
---------------------------------
ভূ মানে পৃথিবী আর কম্পন হলো কাঁপা; সোজাভাবে ভূমিকম্প হলো পৃথিবীর কেঁপে ওঠা। তার মানে পৃথিবী যখন কাঁপে তখন আমরা তাকে ভূমিকম্প বলি। পৃথিবীতে বছরে গড়ে কত ভূমিকম্প হয়, শুনলে কপালে উঠতে পারে চোখ। বছরে গড়ে ছয় হাজার ভূমিকম্প হয়। তবে এগুলোর অধিকাংশই মৃদু যেগুলো আমরা টের পাই না।
পৃথিবীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্লেটের মাঝে দিন দিন প্রচুর শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। এই শক্তির হঠাৎ অবমুক্তিতে পৃথিবীর ভূমিতে এক ধরনের কাঁপুনির সৃষ্টি হয় যা সিস্মিক তরঙ্গ নামে পরিচিত। এই কম্পনের নামই ভূমিকম্প।
ভূমিকম্প বলতে পৃথিবীপৃষ্ঠের অংশবিশেষের হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন বা আন্দোলনকে বোঝায়। হঠাৎ বুঝতে পারলেন আপনার ঘরের কোনো জিনিস নড়ছে, দেয়ালের ঘড়ি, টাঙানো ছবিগুলো নড়ছে, আপনিও ঝাঁকুনি অনুভব করছেন, তখন বুঝতে হবে ভূমিকম্প হচ্ছে।
.
---------------------------------
★ ভূমিকম্প কেন হয়
---------------------------------
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগ। সাধারণ ভৌগোলিক তলের বিচ্যুতি, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ইত্যাদি কারণে ভূমিকম্প হয়। এছাড়া ভূমিতে মাইন বিস্ফোরণ, গভীর নলকূপ হতে অত্যধিক পানি উত্তোলন, তেল ও কয়লা খনি এবং পরমাণু পরীক্ষার কারণেও ভূমিকম্প হয়। সাধারণত তিন ধরনের বিচ্যুতি কারণে ভূমিকম্প হয় নরমাল রিভার্স এবং স্টাইক ম্লিপ।
.
---------------------------------
★ ভূমিকম্পের উৎপত্তি
---------------------------------
সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে-
১. ভূপৃষ্ঠজনিত
২. আগ্নেয়গিরিজনিত
৩. শিলাচ্যুতিজনিত.
.
---------------------------------
★ ভূমিকম্পের প্রকারভেদ
---------------------------------
সাধারণত তিন ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে-
প্রচণ্ড,
মাঝারি ও
মৃদু।
.
আবার উৎসের গভীরতা অনুসারে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
অগভীর,
মধ্যবর্তী
গভীর ভূমিকম্প।
.
ভূমিকম্পের কেন্দ্র ভূপৃষ্ঠের ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে সেটি অগভীর ভূমিকম্প, ভূমিকম্পের কেন্দ্র ৭০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে সেটি মধ্যবর্তী ভূমিকম্প এবং ভূমিকম্পের কেন্দ্র ৩০০ কিলোমিটারের নিচে হলে সেটিকে গভীর ভূমিকম্প বলে।
উপরের আলোচনা থেকে অনেকেই হয়তো ধারণা করে নিয়েছেন ভূমিকম্প বেশী হবার সম্ভাবনা থাকবে প্লেট বর্ডারে। হ্যা, আসলেই তাই। যেখানেই দুটো প্লেটের সংযোগস্থল রয়েছে সেখানেই ঘর্ষণ সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা থাকবে এবং এর ফল স্বরূপ হবে ভূমিকম্প। নিচের ছবিটি দেখুন। এই ছবিতে টেকটনিক প্লেটগুলো এবং সেগুলোর নাড়াচাড়ার গতি পথ দেখানো হয়েছে। জাপান, চিলি, হেইতি বা ইন্দোনেশিয়ার দিকে যদি তাকান তাহলে পরিষ্কার বুঝতে পারবেন কেন ঐ স্থানগুলোতে নিয়মিত বড় বড় ভূমিকম্প হয়ে থাকে। গোটা পৃথিবীতে মোট ১৩টি বড় টেকটনিক প্লেট এবং ছোট ছোট ৩০টি টেকটনিক প্লেট সমন্বয়ে গঠিত।
.
---------------------------------
★ ভূমিকম্পের পরিমাপ
---------------------------------
সিসমোগ্রাফ আবিষ্কারের আগে মানুষ শুধু বলতে পারত ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু কোন মাত্রায় হলো, বলা সম্ভব ছিল না। আধুনিক সিসমোগ্রাফের বয়স প্রায় ১৫০ বছর। ভূমিকম্প মাপা হয় দুইভাবে- তীব্রতা এবং প্রচণ্ডতা বা ব্যাপকতা। ভূমিকম্পের মাত্রা মাপা হয় রিখটার স্কেলে। স্কেলে এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত। রিখটার স্কেলে মাত্রা ৫-এর বেশি হওয়া মানে ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কা।মনে রাখতে হবে, ভূমিকম্প এক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলেই এর মাত্রা ১০ থেকে ৩২ গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে।
.
---------------------------------
★ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা
---------------------------------
৫ - ৫.৯৯ মাঝারি
৬ - ৬.৯৯ তীব্র
৭ - ৭.৯৯ ভয়াবহ
৮ - এর ওপর অত্যন্ত ভয়াবহ
.
---------------------------------
★ রিখটার স্কেল
---------------------------------
ভূমিকম্প ফলে যে শক্তির অবমুক্ত হয় তা পরিমাপের জন্য যে মানদন্ডের ব্যবহার করা হয় তা রিখটার স্কেল নামে পরিচিত। ১৯৩৫ সালে মার্কিন পর্দাথবিদ চালর্স ফ্রান্সিস রিখটার এবং জার্মান ভূতত্ত্ববিদ বেনো গুটেনবার্গ এই স্কেল উদ্ভাবন করেন। আর যে যন্ত্রের সাহায্যে ভূমিকম্প মাপা হয় তাকে সিস্মোমিটার বলে। ভূমিকম্পের ফলে বিশেষ তরঙ্গ (সিস্মিক তরঙ্গ) তৈরি হয়। সিস্মোমিটারে সাহায্যে এই তরঙ্গের ধরনের পাঠ নেওয়া হয়। এই তরঙ্গের বিস্তারে ১০ ভিত্তিক লগারিদম নিয়ে রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের আপেক্ষিক তীব্রতা গণনা করা হয়। যেহেতু স্কেলটি ১০ ভিত্তিক লগারিদম তাই এর প্রতি ২ এককের পার্থক্য দশমিক স্কেলের প্রতি ২ এককের পার্থক্যের ১০ গুণ। অর্থাৎ রিখটার স্কেল অনুযায়ী ৬.০ মাত্রাতে ভূমিকম্পের যতকুটু কম্পন অনুভূত হয় ৭.০ মাত্রার ভূমিকম্পে তার চেয়ে কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি কম্পন অনুভূত হবে।
এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের মাত্রা হল ৯.৫; যা ১৯৬০ সালের ২২ মে মাসে সংগঠিত হয়। এর উৎসস্থল ছিল চিলির রাজধানী সান্তিয়াগো থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরে ক্যানিটি নামক স্থানে এটি গ্রেট চিলিয়ান আর্থকোয়াক নামে পরিচিতি এর প্রভাবে সৃষ্ট সুনামি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা ছাড়িয়ে এশিয়া মহাদেশের জাপান ও ফিলিপাইন এবং অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল।
.
---------------------------------
★কম্পনের তীব্রতা : এমএমআই
---------------------------------
ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার স্কেল দিয়ে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কম্পনের তীব্রতা একাধিক যা মডিফায়েড মার্সিলি ইনটেনসিটি (এমএমআই) স্কেল দিয়ে প্রকাশ করা হয় (১ থেকে ১২ রোমান সংখ্যার মাধ্যমে)। কম্পনের তীব্রতা ভূমিকম্পটির উৎসস্থল থেকে দূরত্বের সঙ্গে সাধারণত কমতে থাকে এবং । নেপালে ২৫ এপ্রিলের এই ভূমিকম্পে কাঠমান্ডুতে আট থেকে নয়, ভারতের উত্তরাঞ্চলে সাত থেতে আট, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে চার থেকে পাঁচ, ঢাকায় তিন থেকে চার তীব্রতা ছিল। মাত্রা এবং তীব্রতাকে গুলিয়ে ফেলে একত্রীকরণ করা ভুল, যা গণমাধ্যমের কর্মীরা প্রায়ই করে থাকেন। বাংলাদেশ ছোট তীব্রতায় কম্পিত হলেও মানুষ ভয়ংকরভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছে।
.
---------------------------------
★ ট্যাকটোনিক প্লেট
---------------------------------
১৯১২ সনে জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রের্ড ওয়েগনার পৃথিবীর মানচিত্র পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এক সময় পৃথিবীর মহাদেশগুলো একত্রে ছিল যা কালক্রমে ধীরেধীরে একে অপরের থেকে দূরে সরে গিয়েছে। ওয়েগনারের এই তত্ত্বকে বলা হয় কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট। এ তত্ত্ব বলে পৃথিবীর উপরিতল কতগুলো অনমনীয় প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত। এই প্লেটগুলোকে বলা হয় ট্যাকটোনিক প্লেট। একেকটি ট্যাকটোনিক প্লেট মূলতঃ পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গলিত পদার্থের বাহিরের আবরণ যা একটি পাথরের স্তর। ভূ-স্তরে যা কিছু রয়েছে তা এই প্লেটগুলোর উপরে অবস্থিত।
.
গোলাকার এই পৃথিবী অনেকগুলো ব্লকে বিভক্ত। পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত মূল যে চারটি স্তর আছে এর মধ্যে কেন্দ্র থেকে প্রথম স্তরটি ১২০০ কিমি., ২য় টি ২৩০০ কিমি., ৩য় টি ২৮০০ কিমি. এবং ত্বকের স্তরটি মাত্র ৮০ কিমি. পুরু। সর্বশেষ বা ত্বকের এই স্তরটি সমস্ত পৃথিবী জুড়ে একটি স্তর নয় বরং বিভিন্ন ব্লক বা প্লেটে বিভক্ত যা ট্যাকটোনিক প্লেট (tectonic plates) নামে পরিচিত।
.
ট্যাকটোনিক প্লেটগুলো একে অপরের সাথে পাশাপাশি লেগে রয়েছে। এগুলো প্রায়ই নিজেদের মাঝে ধাক্কায় জড়িয়ে পড়ে। কখনও মৃদু, কখনও সজোরে। যেহেতু প্লেটগুলো শিলা দ্বারা গঠিত, তাই ধাক্কার ফলে তাদের মাঝে ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়। এই ঘর্ষণের মাত্রা অধিক হলে এক ধরনের শক্তি নির্গত হয় যা ভূ-স্তরকে প্রকম্পিত করে। যদিও ভূমিকম্পের আরও কারণ রয়েছে (যেমন আগ্নেয়গিরি), তবে এই কারণটিই অধিকাংশ ভূমিকম্পের জন্যে দায়ী।
.
ট্যাকটোনিক প্লেট একটির সাথে অন্যটির ঘর্ষনের সৃষ্টি হয়, আঘাত করে এবং কখনো পিছলে পরার ঘটনা ঘটে। দুটি ট্যাকটোনিক প্লেটের সংযোগ স্থলকে বলা হয় প্লেট বাউন্ডারি। একটি প্লেট যখন হঠাৎ করে অন্যটি থেকে স্লিপ করে তখন প্লেট বাউন্ডারি এলাকায় ভূমিকম্পের (earthquake) সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় বড় ভূমিকম্পের আগে বার বার মৃদু আকারে ভূমিকম্প দেখা দেয়। এবং বড় ভূমিকম্পের পর সপ্তাহ, মাস এমনকি বছরান্তে মৃদু ভূমিকম্প ঘটতে দেখা যায়।
.
---------------------------------
★ বাংলাদেশে ভূমিকম্প
---------------------------------
১৮৫৭ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ওই লাইনেই ছিল। বর্তমানেও সেটা পূর্ব দিকে এগিয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে। তবে গভীরতা কমবে কি-না সেটা নিশ্চিত নয়। ওই লাইনকে ভূমিকম্পের ভবিষ্যৎ উৎসস্থল ধরে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, বগুড়া, রংপুর, সৈয়দপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ শহর সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে আছে। কিন্তু ঢাকা শহরের মাটির মান খারাপ ও অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে ওই শহরগুলোর চেয়ে বেশি ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে পড়তে পারে ঢাকা। যদিও ওই শহরগুলোর চেয়ে ঝুঁকির দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে ঢাকা।
সর্বশেষ ১৯১৮ সালে ১৮ জুলাই শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল যা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। কিন্তু ঢাকায় এর প্রভাব সামান্যই পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি ঘটে গড়ে প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে। সেই হিসাবে ঢাকায় ১৩০ বছরে কোন বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়নি যা চট্টগ্রামে ২৫০ বছর এবং সিলেটে ১০০ বছর। এই সময় গ্যাপের কারণে খুব শীঘ্রই একটি ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে।
.
---------------------------------
★ ভূমিকম্প জোনে বাংলাদেশের অবস্থান
---------------------------------
বাংলাদেশ ইন্ডিয়ান প্লেটেরই একটি অংশ। ইন্ডিয়ান প্লেট উত্তর পূর্বদিকে অগ্রসর হচ্ছে। এর আগে বার্মিজ প্লেট এবং উত্তরে তিব্বতিয়ান প্লেট, যা ইউরেশিয়ান প্লেটের একটি অংশ। ইন্ডিয়ান প্লেট উত্তর পূর্বদিকে অগ্রসর হওয়ায় কৌনিকভাবে বার্মিজ এবং তিব্বতিয়ান প্লেটকে ধাক্কা দিচ্ছে। ফলে পূর্বদিকে ইন্ডিয়ান প্লেট দেবে যাচ্ছে বার্মিজ প্লেটের নীচে এবং বার্মিজ প্লেট ওপরে ওঠায় আরকান-ইয়োমা পর্ব শ্রেণীর সৃষ্টি। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-সিলেট এলাকা পর্বতশ্রেণীর অংশ। পৃথিবীর অধিকাংশ ভূমিকম্পের উৎপত্তি দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে। গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে এ ধরনের আরো দুটি ফল্ট রয়েছে (মধুপুর ও দুখাই) যা থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে।
.
কমপ্রিহেনসিভ ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম (সিডিএমপি) এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রধান তিনটি শহর ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ৫ লাখ ৫৮ হাজার স্থাপনা ধ্বসে পড়বে। যাতে ঢাকায় প্রায় ৭৮ হাজার ঝুকিপূর্ণ ভবন রয়েছে যাতে সরকারি ভবন প্রায় ৫ হাজার। দিনে ভূমিকম্প হলে মারা যাবে প্রায় ১.৫ লাখ মানুষ এবং আহত হবে আরও ১ লাখ মানুষ। রাতে ভূমিকম্প হলে আরও প্রায় ২ লাখ মানুষ আহত বা মারা যেতে পারে। সিলেট ও চট্টগ্রামে প্রায় ৯৫ ভাগ বাড়ি ধ্বংস হয়ে যাবে।
.
---------------------------------
★ বাংলাদেশের ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা সমূহ চিহ্নিতকরণ
---------------------------------
দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরেশিয় এবং মায়ানমার টেকটনিক প্লেটের মাঝে আবদ্ধ। ফলে এই প্লেটগুলোর নাড়াচাড়ার ফলে আমাদের দেশে মাঝেমাঝেই ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তাছাড়া ভারতীয় এবং ইউরেশিয় প্লেট দুটো হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে রয়েছে এবং ১৯৩৪ সনের পর গত ২৫ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে নেপালে যে ভূমিকম্প হল এটাই প্লেটগুলোর সবচেয়ে বড় ধরনের নাড়াচাড়া। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এই প্লেট দুটো হয়তো নিকট ভবিষ্যতে আরো নড়ে উঠবে যা বড় ধরনের ভূমিকম্পের কারণ হবে।
.
টেকটনিক প্লেটের অবস্থান দেখলে বোঝা যায় যে, আমাদের উত্তর ও পূর্বে দুটো বর্ডার বা টেকনিকাল ভাষায় “ভূ-চ্যুতি” রয়েছে যা বাংলাদেশের ভূমিকম্পের কারণ। এজন্যে বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চল তথা সিলেট এবং ততসংলগ্ন এলাকা প্রবল ভূমিকম্প প্রবণ। এর পরের অংশগুলোও যেমন ঢাকা ও রাজশাহী শহরও ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। নিচের ছবিতে বাংলাদেশের মানচিত্রে লাল অংশ বেশী, হলুদ মাঝারি এবং সবুজ অংশ কম ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
১৮৯৭ সনের ১২ জুন ৮.৭ মাত্রার “দ্যা গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক” ভারতবর্ষকে আঘাত হানে যা আজও পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ভূমিকম্প হিসেবে পরিচিত। এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ভারতের শিলং শহর। তবে এর প্রভাব বর্তমান বাংলাদেশ সহ বহু দূর পর্যন্ত অনুভূতি হয়েছিল। সে সময়ের ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন মিশনারীদের বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়েছিল এই ভূমিকম্পের কারণে। এছাড়াও ঢাকায় ৪৫০ জনের মত নিহত হবার খবর পাওয়া গিয়েছিল, যা সেই সময়ের তুলনায় রীতিমত অনেক বড় সংখ্যা।
.
এ ভূমিকম্পগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মোটামোটি প্রতি একশ বছর পরপর এই অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। ১৯১৮ সন ছিল সর্বশেষ বড় ভূমিকম্পের বছর। এরপর প্রায় একশ বছর কেটে গিয়েছে কিন্তু আর কোন বড় ভূমিকম্প আঘাত করে নি বাংলাদেশকে, যা বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। অনেক আবহাওয়াবিদ এটাও মনে করেন যে, ছোটছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের বার্তা বহন করে। সে হিসেবে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প যে কোন সময় আঘাত হানতে পারে। আর যদি সেটা ঘটে, তাহলে সেটার ভয়াবহতা হবে মারাত্মক।
.
---------------------------------
★ ভূমিকম্প ঝুঁকি
---------------------------------
ভূমিকম্প ঝুঁকি অনুযায়ী ভূ-তাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশকে তিনটি প্রধান অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। সিলেট বিভাগসহ নেত্রকোনা, শেরপুর, কুড়িগ্রাম জেলা এবং ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, গাইবান্ধা, রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার অংশবিশেষ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে রয়েছে। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ইত্যাদি জেলা মাঝারি ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় পড়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত হলেও বিশেষ করে ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ন, নাজুক দালান-কোঠা এবং অত্যধিক জনসংখ্যা ভূমিকম্পে ক্ষয়-ক্ষতির সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে।
১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে বিশাল এক ভূমিকম্প হয়েছিল (আনুমানিক ৭ থেকে ৮ মাত্রার) যা ইতিহাসে ‘বেঙ্গল আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। এখন যদি ঢাকায় এ ধরনের কোনো ভূমিকম্প হয়, তবে অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। ভূমিকম্পের ফলে ক্ষয়ক্ষতির তীব্রতার যে মাত্রা রয়েছে সে সূচক অনুযায়ী ঢাকা পৃথিবীর শীর্ষ ২০ টি ঝুঁকিপূর্ণ শহরের অন্যতম। ভূমিকম্প ঝুঁকি অনুযায়ী ঢাকাকে চারটি এলাকায় ভাগ করা যায় । ম্যাপে দেখা যাচ্ছে উত্তরা এলাকা সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং খিলগাঁও, বাড্ডা, গুলশান, ক্যান্টনমেন্ট এবং পুরনো ঢাকার বুড়িগঙ্গা সংলগ্ন অঞ্চল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রয়েছে।
.
---------------------------------
★ ভূমিকম্প প্রস্তুতি
---------------------------------
আপনি যদি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকেন তবে খোঁজ নিন আপনার ভবনটিতে ভূমিকম্পরোধক ব্যবস্থা আছে কিনা, থাকলে তা কী মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারবে। যদি না থাকে তবে রেট্রোফিটিং-এর ব্যবস্থা নিন। কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পুরনো ভবনেও রেট্রোফিটিং-এর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। জাপানে ভূমিকম্প একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু তাদের ভবনগুলিতে ভূমিকম্পরোধক ব্যবস্থা থাকায় তাদের ক্ষয়ক্ষতি হয় অতি সামান্য।
.
• পরিবারের সবার সাথে বসে এ ধরনের জরুরী অবস্থায় কি করতে হবে, কোথায় আশ্রয় নিতে হবে- মোট কথা আপনার পরিবারের ইমার্জেন্সি প্ল্যান ঠিক করে সব সদস্যদের জানিয়ে রাখুন। ভূমিকম্পের সময় হাতে খুব সামান্যই সময় পাওয়া যাবে। এ সময় কী করবেন তা সবাইকে নিয়ে আগেই ঠিক করে রাখুন।
• বড় বড় এবং লম্বা ফার্নিচারগুলোকে যেমন- শেলফ ইত্যাদি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখুন যেন কম্পনের সময় গায়ের উপর পড়ে না যায়। আর টিভি, ক্যাসেট প্লেয়ার ইতাদি ভারী জিনিষগুলো মাটিতে নামিয়ে রাখুন।
• বিছানার পাশে সবসময় টর্চলাইট, ব্যাটারী এবং জুতো রাখুন।
• বছরে একবার করে হলেও ঘরের সবাই মিলে আসল ভূমিকম্পের সময় কী করবেন তার একটা ট্রায়াল দিন।
.
---------------------------------
★ ভূমিকম্পের সময় করণীয়
---------------------------------
ভূমিকম্পের সময় কী করা উচিত--
১. বাড়ির ভেতরে থাকলে টেবিল বা খাটের তলায় আশ্রয় নিন
২. কোনও মজবুত আসবাব থাকলে শক্ত করে ধরে থাকুন
৩. বাড়ির কোনও কোণে আশ্রয় নিন
৪. হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকুন
৫. ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়লে চোখ-মুখ ঢেকে রাখুন
৬. ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়লে মুখে আওয়াজ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করুন
.
ভূমিকম্পের সময় কী করা উচিত নয়--
১. বাড়ির বাইরে থাকলে গাছ বা কোনও বহুতলের নীচে দাঁড়াবেন না
২. বেশি নড়াচড়া করবেন না
৩. কোনও দেওয়ালের কাছে দাঁড়াবেন না
৪. গাড়িতে থাকলে ব্রিজে উঠবেন না
.
নিচের পরামর্শগুলো বেশি কার্যকরী যদি ভবনে ভূমিকম্পরোধক ব্যবস্থা থাকেঃ
১। ভূমিকম্পের সময় বেশি নড়াচড়া, বাইরে বের হবার চেষ্টা করা, জানালা দিয়ে লাফ দেবার চেষ্টা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা উচিত। একটা সাধারণ নিয়ম হল- এ সময় যত বেশি মুভমেন্ট করবেন, তত বেশি আহত হবার সম্ভাবনা থাকবে। আপনার ভবনে যদি ভূমিকম্পরোধক ব্যবস্থা থাকে বা রেট্রোফিটিং করা থাকে তবে ভূমিকম্পের সময় বাসায় থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ।
২। আমেরিকান রেডক্রসের পরামর্শ অনুযায়ী- ভূমিকম্পের সময় সবচেয়ে উত্তম পন্থা হল ‘ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন’ বা ‘ডাক-কাভার’ পদ্ধতি। অর্থাৎ কম্পন শুরু হলে মেঝেতে বসে পড়ুন, তারপর কোন শক্ত টেবিল বা ডেস্কের নীচে ঢুকে কাভার নিন, এমন ডেস্ক বেছে নিন বা এমনভাবে কাভার নিন যেন প্রয়োজনে আপনি কাভারসহ মুভ করতে পারেন। কোনো ভবন ভূমিকম্পরোধক হলে তা খুব কমই ধসে পড়ে; যেটা হয় তা হল আশেপাশের বিভিন্ন জিনিস বা ফার্নিচার গায়ের উপর পড়ে আহত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই এগুলো থেকে বাঁচার জন্য এ সময় কোন শক্ত ডেস্ক বা টেবিলের নিচে ঢুকে আশ্রয় নেয়া জরুরী।
৩। ভূমিকম্পের সময় এলিভেটর/লিফট ব্যবহার পরিহার করুন।
৪। ভূমিকম্পের সময় যদি গাড়িতে থাকেন তবে গাড়ি বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকুন। গাড়ির বাইরে থাকলে আহত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৫। ‘মেইন শক’ বা মূল ভূমিকম্পের আগে এবং পরে মৃদু থেকে মাঝারি আরো কিছু ভূমিকম্প হতে পারে যেগুলো ‘ফোরশক’ এবং ‘আফটার শক’ নামে পরিচিত। সতর্ক না থাকলে এগুলো থেকেও বড় বিপদ হয়ে যেতে পারে। সাধারণত কোনো বড় ভূমিকম্পে ‘আফটার শক’ প্রথম ঘণ্টার মধ্য থেকে শুরু করে কয়েক দিনের মধ্যে হতে পারে।
৬। প্রথম ভূমিকম্পের পর ইউটিলিটি লাইনগুলো (গ্যাস, বিদ্যুত ইত্যাদি) একনজর দেখে নিন। কোথাও কোন লিক বা ড্যামেজ দেখলে মেইন সুইচ বন্ধ করে দিন।
.
---------------------------------
★ ভূমিকম্পের সময় আসলে কতটুকু সময় পাওয়া যায়?
---------------------------------
ভূমিকম্পের সময় প্রথম যে কম্পন টের পাওয়া যায় তা হলো প্রাইমারি ওয়েভ বা P-wave. এর গতিবেগ ১-১৪ কিমি/সে পর্যন্ত হতে পারে। এরপর আসে সেকেন্ডারি ওয়েভ বা Shear wave যার গতিবেগ ১-৮ কিমি/সে। এ দু’টো বডি ওয়েভ। এছাড়া লাভ এবং রেলেই নামে আরো দু’টো ওয়েভ আছে যেগুলো সারফেস ওয়েভ এবং তুলনামূলকভাবে শ্লথগতিসম্পন্ন। আমরা ভূমিকম্পে যে ঘরবাড়ি, অবকাঠামো ধ্বংস হতে দেখি তার জন্য মূলত দায়ী সেকেন্ডারি ওয়েভ এবং সারফেস ওয়েভগুলো- কারণ, এগুলোই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। এখন প্রাথমিক ভূ-কম্পন বা P-wave টের পাবার কতো সময় পর বাকিগুলো টের পাবেন? উত্তর হচ্ছে ব্যবধান খুব সামান্য। ধরুন আপনার অবস্থান ভূমিকম্পের এপিসেন্টার বা উৎপত্তিস্থল থেকে ২০০ কিমি দূরে। সেকেন্ডে যদি ১৪ কিমি বেগে P-wave আসে তবে ২০০ কিমি অতিক্রম করতে সময় নেবে প্রায় ১৪ সেকেন্ড। আর এরপর ৮ কিমি/সে বেগে সেকেন্ডারি ওয়েভ আসতে সময় নেবে প্রায় ২৫ সেকেন্ড। অর্থাৎ আপনি ভূমিকম্প টের পাবার মোটামুটি ১১ সেকেন্ডের ব্যবধানে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়ে যাবে। এর মধ্যেই আপনাকে আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
.
---------------------------------
★ ধ্বংসস্তুপে আটকে পড়লে করণীয়
---------------------------------
১। ধুলাবালি থেকে বাঁচার জন্য আগেই সাথে রুমাল বা তোয়ালে বা চাদরের ব্যবস্থা করে রাখুন।
২। ম্যাচ জ্বালাবেন না। দালান ধ্বসে পড়লে গ্যাস লিক হয়ে থাকতে পারে।
৩। চিৎকার করে ডাকাডাকি শেষ অপশন হিসেবে বিবেচনা করুন। কারণ, চিৎকারের সময় মুখে ক্ষতিকারক ধুলাবালি ঢুকে যেতে পারে। পাইপে বা ওয়ালে বাড়ি দিয়ে বা মুখে শিস বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে পারেন। তবে ভাল হয় সাথে যদি একটা রেফারির বাঁশি বা হুইসেল থাকে, তার প্রিপারেশন নিয়ে রাখুন আগেই।
প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মানুষের নেই। কিন্তু মানুষ সতর্ক হতে পারে। গত ২৫ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে নেপালে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে আট হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কুঁড়ি হাজারেরও বেশি মানুষ। তখন ভারত ও বাংলাদেশেও সেই ভূমিকম্পের তীব্র কম্পন টের পাওয়া গেছে। আজ ১২ মে ২০১৫ তারিখে আবার এভারেস্ট ও কাঠমান্ডুর মাঝখানে ৭.৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এরপর আফটার শক যে ভূমিকম্প হয়েছে তার মাত্রা ৬.৩। তবে আজকের ভূমিকম্পে নেপালে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তেমন বেশি নয়। আজও বাংলাদেশে এই ভূমিকম্প টের পাোয়া গেছে কিন্তু এটা ২৫ এপ্রিলের চেয়ে কম তীব্রতর ছিল।
.
---------------------------------
★ ভূমিকম্পের পূর্ব প্রস্তুতি
---------------------------------
২৫ ও ২৬ এপ্রিল, এরপর আবার ১২ মে,২০১৫ পরপর কয়েকটি ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে বাংলাদেশ। এর কেন্দ্র নেপালে, দুদিন ধরে সেখানে দফায় দফায় ভূমিকম্প ঘটেই চলেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত ও ভুটানের মতো কাছের দেশগুলোও। উত্তর ভারতেও অর্ধশত প্রাণহানি ঘটেছে। বাংলাদেশেও তিনজন লোক মারা গেছে বলে গণমাধ্যমে এসেছে। রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে কিছু ভবন হেলে পড়েছে বলে জানা গেছে।ভূমিকম্প যেহেতু বলে-কয়ে আসে না এবং পৃথিবী থেকে এর বিদায় নেওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই, তাই ভূমিকম্পে প্রস্তুতি ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।
একসময় ছিল যখন ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় দ্বিতল বাড়ির অধিক উচ্চতার বাড়ি ছিল না। ওই অবস্থায় ভূমিকম্প হলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাড়ির বাইরে খোলা জায়গায় বের হয়ে আসা সম্ভব ছিল। কিন্তু এখন বহুতল বা সুউচ্চ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলো থেকে ৩০-৪০ সেকেন্ডের একটি কম্পনের মুহূর্তে গ্যাসলাইন, বিদ্যুৎ লাইন ইত্যাদি বন্ধ করে হাঁকডাক দিয়ে পরিবারের লোকজন সঙ্গে করে বের হয়ে আসা (তা–ও লিফট ব্যবহার করা যাবে না বলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে) অসাধ্য।
.
কম্পনের মুহূর্তে এসব সুউচ্চ ভবন থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা না করে নিজ নিজ ফ্ল্যাটের মধ্যে আশ্রয় খোঁজা ভালো, যে সম্পর্কে নির্দেশনামূলক লেখা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। দেশে থাকা ভূমিকম্পের কোড মেনে তাঁরা ভবন ডিজাইন ও নির্মাণ করছেন কি না, সে বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকা দরকার। জাপানের টোকিও শহরে শিনজুকু এলাকায় ৫০ তলা বা তদূর্ধ্ব ভবন কয়েক ডজন আছে। অফিসের সময় বড় তীব্রতার কম্পন হলেও এসব অফিসে কাজ করা লোকজন এক ইঞ্চিও নড়েন না। বরং তাঁরা আশপাশের ভবনগুলোর দোল খাওয়া নিজ ভবনের প্যানারোমিক উইন্ডো থেকে দেখে মজা পান। এর মূল কারণ স্টিলের ফ্রেমের ওপর তৈরি (কিছু কংক্রিটের তৈরি) এসব ভবন কতটা তীব্রতা সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে সে সম্পর্কে জনগণের আস্থা।
.
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাকিল আকতার বলেন, পরিকল্পিত নগরায়ন ছাড়া ভূমিকম্প সহনশীল নগর তৈরি করা সম্ভব না। তিনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে বলেন, এখানকার নগরায়ন যে দিকে হচ্ছে সেটা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাতেই হচ্ছে। ভূমিকম্প থেকে বাঁচার জন্য একটি শহরের প্রস্তুতির মধ্যে শহরের ভবনগুলো বিশেষ করে জরুরি সাহায্য যেমন হাসপাতাল, দমকলবাহিনীর ভবনগুলো ভূমিকম্প নিরোধক করতে হবে। শহরের মাঝে মাঝে খোলা মাঠ এবং খোলামেলা জায়গার খুব প্রয়োজন রয়েছে শুধুমাত্র ভূমিকম্পের সময় আশ্রয়স্থল নয় পরবর্তী আফটার শকের সময়গুলোতে সেখানে আশ্রয় নেওয়ার জন্য কয়েকটি বাড়ি পরপর খোলা জায়গার বিকল্প নেই।
.
যদি রানা প্লাজার কলামে ফাটল দেখার পর ব্যবহার থেকে বিরত থেকে ভবনের কলামকে রেট্রোফিটিং করা হতো, তবে ওই বিপর্যয় খুব সহজে এড়ানো যেত। রেট্রোফিটিং বিষয়টি হলো একটি দুর্বল কাঠামোকে শক্তিশালীকরণ। কাঠামোটি যখন নির্মিত হয়েছিল তখন অজ্ঞতাবশত বা যে কারণেই হোক দুর্বলভাবে নির্মিত হয়েছিল, পরে তাকে প্রয়োজনীয় শক্তিশালীকরণই হচ্ছে রেট্রোফিটিং।কলামকে আরসি জ্যাকেটিং করে এবং দুই কলামের মাঝে ব্রেসিং, সিয়ার ওয়াল বা উইং ওয়াল নির্মাণ করে দুর্বল কার পার্কিং তলাটিকে রেট্রোফিটিং করা যায়। এ জন্য সচেতনতার বিষয়টি খুবই জরুরি। ২০ কোটি টাকার একটি ভবনের দুর্বল বা ত্রুটি ২০ লাখ টাকা খরচ করে শক্তিশালী করিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার মতো ইচ্ছা থাকতে হবে।জাইকার অর্থায়নে ঢাকার সেগুনবাগিচার গণপূর্ত ভবনের একটিতে কয়েকটি পদ্ধতিতে রেট্রোফিটিংয়ের কাজ করে রাখা হয়েছে, যা সহজেই সরেজমিনে দেখা যেতে পারে। এ ভবনের নকশা ও কাঠামোর ডিজাইন করার সময় এই ত্রুটির বিষয়টি স্থপতি ও কাঠামো প্রকৌশলীর মাথায় থাকা দরকার। দেশের পাঁচটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ও সব কটি কারিগরি প্রতিষ্ঠানে রেট্রোফিটিং বিষয়টি পাঠদানের অন্তর্ভুক্ত করা খুবই প্রয়োজন। এর মধ্য দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকে নিরাপদ ভবনে রূপান্তরিত করা দরকার। আর নতুন ভবনগুলো যেন এসব ত্রুটিমুক্ত থাকে, সেদিকে খেয়াল থাকা দরকার। তাহলে ভবনের ওপর বাসিন্দাদের আস্থা সুদৃঢ় হবে।


No comments:

Post a Comment