Sunday 10 January 2016

৩৬ লিখিত ১ঃ আন্তর্জার্তিক বিষয়াবলি by Samad Azad [Admin, BCS: Our Goal [Largest Job group of Bangladesh]]

সম্ভাব্য প্রশ্ন : (বড় প্রশ্ন বা টীকা)
১। গ্রিস অর্থনৈতিক সংকটের কারণসমূহ উল্লেখ করুন।
২। গ্রিসের দেউলিয়া হওয়ার পেছনে দায়ভার কার? এটি কি পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের আদর্শের লড়াই?
৩। আপনি কি মনে করেন 'ইউরোই গ্রিসের অর্থনৈতিক ধসের কারণ' - মন্তব্য করুন।
৪। গ্রিসের অর্থনৈতিক ধসেই কি অবসান হবে ইউরো যুগের - আপনার মতামত উল্লেখ করুন।
৫। গ্রিসের পতনের ফলে ইউরোজোনে কিরূপ প্রভাব পড়বে? 
৬। গ্রিস অর্থনৈতিক সংকটের ফলে বাংলাদেশে কিরূপ প্রভাব পড়বে - উল্লেখ করুন। 
৭। গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট আমাদের জন্য কী শিক্ষণীয় / সতর্ক বার্তা - আলোচনা করুন।
৮। গ্রিস সংকটের ভবিষ্যত / গ্রিসের ভবিষ্যত সম্পর্কে আপনার মতামত পেশ করুন।
৯। গ্রিস ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ - সম্পর্কে আপনার মতামত উল্লেখ করুন।
১০। গ্রিস সংকট সমাধানে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ উল্লেখ করুন।
ক. গণভোটের আয়াজন 
খ. অর্থনৈতিক সংস্কার প্রস্তাব পার্লামেন্টে পাস 
গ. গ্রিস সংকট নিয়ে কী সমাধানে পৌঁছেছে ইউরোজোন
------------------------------------------
আন্তর্জার্তিক বিষয়াবলির (লিখিত) সিলেবাসে উল্লেখকৃত বিষয় (Related Topics): 
* International Economic Relations: ..... debt crisis ... 
* Major Issues and Conflicts: contemporary issues.
* Global Initiatives and Institutions: EU, WB, IMF.
* Section C: Problem-solving. 
______________________
.
ইতিহাসের অভিধায় ধ্রুপদী সভ্যতা ও সংস্কৃতির দেশ গ্রিস। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও দর্শনশাস্ত্র গড়ে ওঠার পটভূমি অনেকটাই আবর্তিত হয়েছিল দেশটিকে ঘিরে। বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে গেলে প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্র এথেন্সের কথা বলতে হয়। পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতির নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, অনুসিদ্ধান্ত ও রীতি-নীতি প্রতিষ্ঠায় গ্রেকো-রোমান অর্থনীতিবিদদের ভূমিকাও ইতিহাসসিদ্ধ। সম্প্রতি এ গ্রিসের অর্থনীতিই এমন একটি সংকটের সম্মুখীন হয়েছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ভূমিকা ও অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।


=======================
★ অর্থনৈতিক সংকটের/পতনের কারণসমূহ
=======================
১। ইউরো মুদ্রা:
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন ইউরোই গ্রিসের অর্থনৈতিক ধসের কারণ। বিশ্লেষকদের মতে, গ্রিস সংকটের জন্য ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি চালু হওয়া ইউরোজোনভুক্ত দেশগুলোর অভিন্ন মুদ্রা ইউরোই দায়ী। ইউরোজোনভুক্ত হওয়ার আগে ঋণদাতারা গ্রিসকে মধ্য আয়ের একটি দেশ হিসেবে দেখতো। ফলে এখানে অতিরিক্ত অর্থলগ্নিকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতো। কিন্তু ইউরোজোনভুক্ত হওয়ার পর ঋণদাতারা গ্রিসকে আর বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেনি। সেসময় ঋণদাতারা ভাবলো, দেশটি আর মধ্য আয়ের দরিদ্র রাষ্ট্র নেই। পরবর্তিতে দিনে দিনে জমতে থাকে তাদের ঋণের বোঝা। আর এই বোঝাই আজকের অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে গ্রিসকে।
.
২। আইএমএফ ও ইসিবি এর উচ্চ সুদে ঋন:
ইউরোজোনভুক্ত হওয়ার পর ঋণদাতারা গ্রিসকে বিনিয়োগের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে জার্মানিকে যে সুদে ঋণ দেয়, সেই উচ্চ হারে গ্রিসকেও ঋণ দেওয়া শুরু করলো।আর ঋণ পেতে হলে ওই হার মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না দেশটির সরকারের সামনে। কারণ একটাই, তার মুদ্রাও তখন ইউরো। ফলে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়ায় ও ইউরোজোনভুক্ত হওয়ায় শ্রমবাজারে মজুরির পরিমাণ বাড়াতে হলো। ফলে খুব দ্রুত বাণিজ্য কয়েকগুন বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে অর্থনীতিতে অব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্টদের অসততা সরকারের ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়ে দেয়।
.
৩। সংস্কার প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার অভাব:
গ্রিসের আজকের ঋণগ্রস্ত হয়ে দেউলিয়া হওয়ার পেছনে রয়েছে বিগত তিনটি নির্বাচিত সরকারের দায়ভার, যারা বিগত বছরগুলোতে জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে দেশজ খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টা বা ধারাবাহিক সংস্কারের পথে না হেঁটে ঋণ নিয়ে দেশ চালানোর কাজেই সচেষ্ট হয়েছে। গ্রিস সেই ২০০২ সাল থেকেই ইউরো মুদ্রাব্যবস্থা প্রচলনের প্রথম ১০টি দেশের একটি হলেও গ্রিস ১৩ বছর ধরে ঘাটতি বাজেট কমাতে নানা ধরনের সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে কেবল গড়িমসিই করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার মূল তিনটি স্তর, রাজস্ব আদায়ের সংস্কৃতি, পেনশন দেওয়ার ক্ষেত্রে অপরিণামদর্শী নিয়ম এবং দেউলিয়া হয়ে যাওয়া জাতীয় বিভিন্ন সেবা সংস্থাকে বছরের পর বছর অযৌক্তিকভাবে ভর্তুকি দেওয়ার নীতি থেকে তারা সরে আসতে চায়নি।
.
৪। বাণিজ্য ঘাটতি:
উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়ায় ও ইউরোজোনভুক্ত হওয়ায় শ্রমবাজারে মজুরির পরিমাণ বাড়াতে হয়। ফলে খুব দ্রুতই বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয়। ১৯৯৯ সালে বাণিজ্য ঘাটতি যেখানে দেশটির জিডিপির ৫ শতাংশেরও কম ছিল, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এসে তা বেড়ে ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল।
.
৫। পেনশন ব্যবস্থা:
২০১২ সালের ইউরোস্ট্যাট তথ্য অনুযায়ী, দেশটির জিডিপির সাড়ে ১৭ শতাংশ খরচ হয় পেনশন খাতে। অথচ ইতালি, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার মতো দেশগুলোতে এ খরচ ১৫ শতাংশের বেশি নয়। এই বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থব্যয়ও দেশটিকে ধসের মুখে ঠেলে দিয়েছে বলে অর্থনীতিবিদদের অভিমত।
.
৬। র্অথনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও র্দূনীতি:
দেশটির অর্থনীতিতে অব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্টদের অসততা সরকারের ঋণের বোঝা আরো বাড়িয়ে দেয়।
.
৭। কর আদায়ে সচেতন না হওয়া:
গ্রীসের জনগোষ্ঠীর মধ্যে কর প্রদানে রয়েছে অমনযোগিতা বিশেষ করে ধনী নাগরিকদের মধ্যে কর দেওয়ায় কোনো প্রবণতাই পরিলক্ষিত হয় না। দেশটির ৬০০ ধনাঢ্য ব্যক্তি কর ফাঁকি দিয়ে তাঁদের সব অর্থ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে জমা রেখেছেন। দেশটির বিশাল বাণিজ্য জাহাজ পরিবহন খাতের অর্ধেকেই কোনো কর প্রদান করে না। উপরন্তু গ্রিসের জটিল কর ব্যবস্থাও জনগণকে কর দিতে নিরুৎসাহিত করে বলে মত বিশ্লেষকদের। আর কর ফাঁকি দেওয়াদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট অধিদফতর এবং নিরাপত্তা সংস্থাও ব্যর্থ হয়েছিল।
.
৮। আয় সংকোচন ও ব্যয় বৃদ্বি:
গ্রিসের সরকার সরকারি খাতের আকার ক্রমাগত বাড়িয়ে গেছে; অথচ আয়কর আদায়ের দিকে লক্ষ রাখেনি। ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য হয়ে যায়।
.
অপব্যয়ী অর্থনৈতিক নীতি:
বেশ কয়েক বছর ধরে অপব্যয়ী অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করে আসছে গ্রিস। ২০০৪ সালে অলিম্পিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেছে; কিন্তু সেখান থেকে তেমন রিটার্ন আসেনি।
.
৯। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি:
সরকারি ব্যয়ের উচ্চহারের কারণে মুদ্রাস্ফীতি ছিল সর্বোচ্চ; প্রায় ১২ শতাংশ। অথচ ইউরো জোনে মুদ্রাস্ফীতির মাত্রা নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছিল ৩ শতাংশ পর্যন্ত মুদ্রাস্ফীতি হতে পারবে। এ ক্ষেত্রেও গ্রিস ব্রাসেলসকে ফাঁকি দেয়। ধোঁকাবাজি করে রাষ্ট্রীয় বুককিপিং বা হিসাবরক্ষণ প্রণালি ঠিকঠাক আছে দেখিয়ে গ্রিস বেশ ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিল।
.
১০। মন্দা সময়ে প্রস্তুতির ঘাটতি ও উচ্চ বিলাসিতা:
যখন মন্দা অর্থনীতিকে আঘাত করতে শুরু করে, তখনো সংকট মোকাবিলায় গ্রিসের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। তারা। ভেবেছে, সংকটে পড়লে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার তাদের সাহায্য করে যাবে।
.
১১। বেসরকারিখাতকে উৎসাহিত করতে ব্যর্থ হওয়া:
ইউরোজোনে ঢোকার পরপরই গ্রিক সরকার ঘোষণা দেয়, উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধির জন্য দেশে বেসরকারিখাতকে উৎসাহিত করা হবে। কিন্তু সঠিকভাবে বেসরকারিখাতকে উৎসাহিত করতে না পারায় ঋণের বোঝা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা পরিশোধের পথ হয়ে হয়ে পড়েছে সংকীর্ণ।
.
১২। র্কম সংস্থান না করে র্কমী ছাটাই:
ব্যয় কমাতে সরকার ব্যাপকভাবে কর্মী ছাঁটাই শুরু করে।বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম মানুষ বেকারত্বের শিকার হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি।
.
১৩। উৎপাদন হ্রাস পাওয়া:
ব্যয় কমাতে গ্রিসে ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন-ভাতা হ্রাস করা হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে জাতীয় আয়ে।আশঙ্কাজনক হারে কমে যায় উৎপাদন।
.
=======================
★ দেউলিয়া হওয়ার পেছনে দায়ভার কার
★ পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের আদর্শের লড়াই কিনা
=======================
গ্রিস গণতন্ত্রের সূতিকাগার বটে, তবে প্রকৃত গণতন্ত্রচর্চাটা বিগত দশকে তাঁরা কমই করেছেন। বছরের পর বছর ঋণ নিয়ে ঘাটতি বাজেট, অর্থনৈতিক খাতে চরম বিশৃঙ্খলা ও ধারাবাহিক সংস্কারের পথে না হেঁটে ইউরো জোনভুক্ত অন্য দেশগুলোর জনগণের করের অর্থ ঋণ নিয়ে না ফেরত দেওয়ার সংস্কৃতি গ্রিসের মতো দেশকে দেউলিয়া করে ছেড়েছে।
.
যে দেশটি ঋণের দায়ে গলা পর্যন্ত নিমজ্জিত, যে দেশটির ৬০০ ধনাঢ্য ব্যক্তি কর ফাঁকি দিয়ে তাঁদের সব অর্থ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে জমা রেখেছেন, যে দেশটির বিশাল বাণিজ্য জাহাজ পরিবহন খাতের অর্ধেকেই কোনো কর প্রদান করে না, যে দেশটি পৃথিবীর ১৭৪টি দেশের মধ্যে দুর্নীতির সূচকে ১১০ নম্বরে অবস্থান করছে বা ঘুষ বাণিজ্য ছাড়া যেখানে প্রশাসন চলে না, সেই দেশের সমাজ বা অর্থনীতির খোল নলচে পাল্টিয়ে দেওয়া এতটাই সহজ নয়। প্রবল প্রতিপত্তিসম্পন্ন দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করা বা জনগণের স্বার্থে সিরজা দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তাই অচিরেই বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
আজকে গ্রিসের যে দেউলিয়া অবস্থা, সেই একই ধরনের বা কিছুটা লঘু সংকটে নিমজ্জিত হয়েছিল ইউরো জোনভুক্ত দেশ আয়ারল্যান্ড, সাইপ্রাস, ফিনল্যান্ড ও পর্তুগালের মতো ছোট দেশগুলোও। তবে দীর্ঘস্থায়ী সুফলের আশায় সংকটাপন্ন দেশগুলো ঋণ গ্রহণ করে বা তাদের ঘাটতি বাজেট ক্রমান্বয়ে কমিয়ে এনে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এনেছে।
.
ঋণ নিয়ে ঘাটতি বাজেট, অর্থনৈতিক খাতে চরম বিশৃঙ্খলা ও ধারাবাহিক সংস্কারের পথে না হেঁটে ইউরো জোনভুক্ত অন্য দেশগুলোর জনগণের করের অর্থ ঋণ নিয়ে না ফেরত দেওয়ার সংস্কৃতি কখনোই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। তাই গ্রিসের আজকের সমস্যা গ্রিসের গণতন্ত্রের প্রতি কোনো হামলা বা পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের আদর্শের লড়াই নয়। লড়াইটি গ্রিসের রাজনীতিকদের সঙ্গে সে দেশের আপামর সাধারণ বঞ্চিত জনগণের বোঝাপড়ার লড়াই।
.
=======================
★ ইউরোই গ্রিসের অর্থনৈতিক ধসের কারণ
=======================
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন ইউরোই গ্রিসের অর্থনৈতিক ধসের কারণ। বিশ্লেষকদের মতে, গ্রিস সংকটের জন্য ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি চালু হওয়া ইউরোজোনভুক্ত দেশগুলোর অভিন্ন মুদ্রা ‘ইউরো’ই দায়ী। গ্রিসের বর্তমান ঋণ ৩২০ বিলিয়ন ইউরো (২৭ লাখ ৮১ হাজার ৫২৭ কোটি টাকার কিছু বেশি)। বর্তমানে দেশটির জাতীয় ঋণ তার জিডিপি’র ১৭৭ শতাংশ। এর বেশিরভাগই ইউরোজোন সরকারগুলোর কাছ থেকে নেওয়া। নির্ধারত সময় ৩০ জুনের মধ্যে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) প্রথম কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় ঋণখেলাপের তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে দেশটি। কিন্তু ঋণের মাধ্যমে অর্থলগ্নি বাড়লে গ্রিসের অর্থনৈতিক ভিত্তি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার কথা ছিল। শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে জাতীয় আয় কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার কথা ছিল।এত দিনে ঋণখেলাপি নয়, ঋণদাতা রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কথা দেশটির। কিন্তু এক্ষেত্রে গ্রিসের ভাগ্যাকাশে খলনায়ক হিসেবে দেখা দিয়েছে ইউরো।
.
সমস্যার শুরুটা হয়েছিল গ্রিসের ইউরোজোনে প্রবেশের পরপরই। ইউরোজোনভুক্ত হওয়ার আগে ঋণদাতারা গ্রিসকে মধ্য আয়ের একটি দেশ হিসেবে দেখতো। ফলে এখানে অতিরিক্ত অর্থলগ্নিকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতো। কিন্তু ইউরোজোনভুক্ত হওয়ার পর ঋণদাতারা গ্রিসকে আর বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেনি। সেসময় ঋণদাতারা ভাবলো, দেশটি আর মধ্য আয়ের দরিদ্র রাষ্ট্র নেই। পরবর্তিতে দিনে দিনে জমতে থাকে তাদের ঋণের বোঝা। আর এই বোঝাই আজকের অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে গ্রিসকে।
.
ইউরোজোনভুক্ত হওয়ার পর ঋণদাতারা গ্রিসকে বিনিয়োগের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে জার্মানিকে যে সুদে ঋণ দেয়, সেই উচ্চ হারে গ্রিসকেও ঋণ দেওয়া শুরু করলো।আর ঋণ পেতে হলে ওই হার মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না দেশটির সরকারের সামনে। কারণ একটাই, তার মুদ্রাও তখন ইউরো। ফলে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়ায় ও ইউরোজোনভুক্ত হওয়ায় শ্রমবাজারে মজুরির পরিমাণ বাড়াতে হলো। ফলে খুব দ্রুত বাণিজ্য কয়েকগুন বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে অর্থনীতিতে অব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্টদের অসততা সরকারের ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়ে দেয়।
.
=======================
★ গ্রিসের পতন: ইউরোজোনে কি প্রভাব পড়বে
★ গ্রিসের অর্থনৈতিক ধসেই কি অবসান হবে ইউরো যুগের
=======================
১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি চালু হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) রাষ্ট্রগুলোর অভিন্ন মুদ্রা ইউরো। ১৬ বছর নির্বিঘ্নে পার করে দেওয়ার পর ২০১৫ সালে এসে যেন শক্তিশালী এই মুদ্রার কানে বাজতে শুরু করেছে ভাঙনের সুর। এর অন্যতম কারণ গ্রিস।
উন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম ঋণখেলাপী দেশ এখন গ্রিস। গ্রিসের বিপর্যস্ত অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে শেয়ার বাজার নিম্নমুখী, সঙ্গে ঘটেছে ইউরোর দরপতন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রিস অর্থনীতি ধসে পড়াটা ব্যাপক প্রভাব ফেলবে ইউরোপের বাকি অংশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে। গ্রিসের বর্তমান ঋণের পরিমাণ ৩২০ বিলিয়ন ইউরো। এর বেশিরভাগই ইউরোজোন সরকারগুলোর কাছ থেকে নেওয়া। এর মধ্যে শুধুমাত্র জার্মানির কাছে গ্রিসের ঋণ ৯২ বিলিয়ন ইউরো। যদি ঋণখেলাপের দায়ে ইউরোজোন থেকে বেরিয়ে যায় দেশটি, তাহলে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটকে যাবে। এর ফলে ইইউ রাষ্ট্রগুলোও পড়বে অর্থনৈতিক সংকটে। এর ফলে ইউরোপ মহাদেশের রাজনীতির চিত্র পাল্টে যাওয়ার পাশাপাশি ইইউ রাষ্ট্রগুলোর জোট ভেঙ্গে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। আর এর পরিণাম হতে পারে, ১৬ বছরের রাজত্ব শেষে ইউরো শাসনের পতন।
.
=======================
★ গ্রিসের পতন: বাংলাদেশে কি প্রভাব পড়বে
=======================
গ্রিসের বিপর্যস্ত অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে শেয়ার বাজার নিম্নমুখী, সঙ্গে ঘটেছে ইউরোর দরপতন। গ্রিস সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্ণর এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবদ সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন,
"গ্রিসের সঙ্কট সরাসরি প্রবাসী আয়ে পড়বে। আর এ সংকট দীর্ঘ মেয়াদে হলে রপ্তানিতেও চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দেশটির এ সংকট যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাতের জন্য দু:সংবাদ বয়ে আনবে।"
.
১। প্রবাসী আয় হ্রাস পাবে:
গ্রিস সংকটে তাৎক্ষণিকভাবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। দেশটিতে চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে প্রবাসীরা বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখিন হবেন। গ্রিসে বাংলাদেশিদের পরিচালিত ২৫০টি কারখানার মধ্যে অধিকাংশই পোশাক কারখানা। এসব কারখানায় প্রায় পাঁচ হাজার বাংলাদেশি কাজ করেন। আসন্ন বিপদে এরই মধ্যে অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী গ্রিস ছেড়েছেন। আর যাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, শেষ পর্যন্ত তাদের হয়তো দেশেই ফিরে আসতে হতে পারে। এতে কমে যাবে প্রবাসী আয়।
২। রপ্তানি আয় হ্রাস পাবে:
গ্রিস সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় হ্রাস পাবে। বাংলাদেশ গ্রিসে চিংড়ি, চামড়া, খাদ্যপণ্য ও পাটের সুতা প্রভৃতি পণ্য রপ্তানি করে। দেশটির অর্থনৈতিক এ সংকটের প্রভাব এখন এসব খাতেও পড়বে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ইতোমধ্যে গ্রিসে বাংলাদেশের রপ্তানি কমেছে।
.
৩। পোশাক শিল্পের জন্য হুমকিস্বরূপ:
গ্রিস সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে এর প্রভাব ইউরোপের অন্য দেশে পড়বে। এতে দেশের পোশাক রপ্তানির খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কেননা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ৬০ শতাংশই রপ্তানি হয় ইউরোপের দেশগুলোতে।
.
৪। শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে:
এদিকে গণভোটে গ্রিসের জনগণ ঋণের জন্য দাতাদের দেওয়া কঠোর শর্তাবলী গ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের পুঁজিবাজারের সূচকের পতন হয়েছে। এশিয়ার বৃহৎ পুঁজিবাজারের মধ্যে হংকং স্টক এক্সচেঞ্জে দরপতন হয়েছে। ভারতের পুঁজিবাজারেও পড়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব। বাংলাদেশের উভয় স্টক এক্সচেঞ্জেও সূচকের পতন ঘটেছে।
.
# মন্তব্য: সংকট স্বল্পস্থায়ী হলে প্রভাব :
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় থাকায় কারণে বাংলাদেশে গ্রিস সংকটের ছায়া পড়ার আশঙ্কা নেই। প্রবৃদ্ধি ধারা ৬ শতাংশের উপর থাকলে বাংলাদেশ গ্রিসের মতো অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে না। বরং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাসহ সকল ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠ করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়াবে শক্ত ভিত্তির উপর।
.
# মন্তব্য: সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে প্রভাব :
তবে গ্রিস সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে এর প্রভাব ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে পড়বে।ফলে ইউরোপে আমাদের রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় হ্রাস কমবে এবং পোশাক রপ্তানির খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
.
=======================
★ গ্রিস সংকট কী শিক্ষা / সতর্ক বার্তা বহন করে
=======================
গ্রীসের পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটিগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে। গ্রিসের পরিণতি বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় বটে। দুর্নীতি, আর্থিক খাত থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাত্, সরকারের অপব্যয়, বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে যাওয়া, সরকারে ভর্তুকি ও ঋণ বৃদ্ধির মতো বিষয়ে আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে।
.
১। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ও ঋণের সুদ পরিশোধে এরই মধ্যে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে সরকারকে। এতে উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও চলমান বড় একাধিক প্রকল্প এখনও সম্পন্ন হয়নি।উপরন্তু কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছে প্রকল্প ব্যয়।
.
২। গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ছে। প্রবৃদ্ধি ৭ বা ৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়া সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
.
৩। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের জুলাই মাস থেকে সম্প্রসারিত কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচীর আওতায় কাজ করে আসছে। এতে করে সরকারের ৯টি ক্ষেত্রে করনীয় কাজ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে দাতাগোষ্ঠী, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফএর পক্ষ থেকে। বাংলাদেশ ঋণ গ্রহন করে এ শর্ত মেনেই। এগুলো হচ্ছে গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা, সরকারি ব্যয় হ্রাস করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাদ্যসহ সেবামূলক খাত ও কৃষিখাতে ভর্তুকী হ্রাস করা, প্রকৃত মজুরী হ্রাস ও ঋণ সংকোচন, দাম নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার, জনসেবামূলক খাত, কৃষি উপকরণ, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে বেসরকারীকরণ, উচু কর ও সুদের হার বাড়ানো, আমদানি অবাধ করা, মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। গ্রীসের ক্ষেত্রে আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছিল এর সাথে অনেক ক্ষেত্রেই এর মিল আছে। ফলে আইএমএফ এর শর্তের কারনে গ্রীস যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, বাংলাদেশ যাতে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে না পড়ে, সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
.
কিছু কিছু বিষয় গ্রিসের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।তাই গ্রিস সংকট আমাদের জন্য একটি সতর্ক বার্তাও বটে। প্রত্যাশা থাকবে, বাংলাদেশ সরকার অযাচিত ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরে রাষ্ট্রের ঋণের বোঝা কমিয়ে আনবে। বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানি প্রতিষ্ঠান নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। একই সঙ্গে ভর্তুকি ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে হবে। সর্বোপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে। তাছাড়া গ্রিসের প্রভাব যেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে না পড়ে, সেদিকেও নজর দিতে হবে।
.
======================
★ গ্রিস সংকটের ভবিষ্যত / গ্রিসের ভবিষ্যত
======================
গ্রীস আদৌ আইএমএফ তথা ‘ট্রয়কা’ (আইএমএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) এর ‘দুষ্টচক্র’ থেকে বের হয়ে আসতে পারবে কিনা, এটা একটা পশ্ন এখন। গ্রীসের এই দেউলিয়া হয়ে যাবার ঘটনা এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো খুব কম ক্ষেত্রেই এই ‘ঋণের দুষ্টচক্র’ থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। একটি উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রও যে ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে, এটা এই প্রথমবারের মতো প্রমাণিত হলো।ফলে ইউরোপের আরো অনেক দেশ নিয়ে এই প্রশ্ন থাকল।
.
গ্রীসের পরিস্থিতি আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলের মতই হবে। এই দুটো দেশই অতীতে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক তাদের স্বার্থেই দেশ দুটোকে আবারো ঋণ দিয়েছিল। যাতে দেশ দুটো ঋণের সুদ পরিশোধ করতে পারে। আর ঋণ না দিলে আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দিতে বাধ্য। এজন্যই ঋণের পরিমান বাড়লেও, পুঁজিবাদী সংস্থাগুলো তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য ভবিষ্যতেও গ্রিসকে ঋণ দিয়ে যাবে। চূড়ান্ত বিচারে ‘ট্রয়কা’ তাদের স্বার্থেই গ্রীসকে আরো ঋণ দেবে। এতে করে গ্রীসের অর্থনীতি পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে কিনা তা সময়ই বলে দিবে।
.
=======================
★ গ্রিস ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ
=======================
গ্রীস যদি ইউরো জোন থেকে বের হয়ে যায়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ কি? গ্রিস সংকটের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ এখন কোন পথে? সম্প্রতি এ গ্রিসের অর্থনীতিই এমন একটি সংকটের সম্মুখীন হয়েছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ভূমিকা ও অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
.
১৯৫৭ সালে ইউরোপীয়ান কমিউনিটি সৃষ্টির পর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত ম্যাসট্রিচট চুক্তি ছিল অভিন্ন ইউরোপ গঠনের লক্ষ্যে একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ। ম্যাসট্রিচট চুক্তিতে একটি একক মুদ্রা ও একটি ইউরোপীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো চালুর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে অভিন্ন এক ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ইউরোপ।
.
১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিউনিটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নাম ধারণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতোমধ্যে সম্প্রসারণ ঘটেছে। পূর্বে ইউরোপের সমাজতন্ত্রের পতনের পর বেশ ক’টি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইইউতে যোগ দিয়েছে। ইইউ’র সদস্য সংখ্যা এখন ২৮। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন ইইউ’র ১৫ টি দেশের মাঝে ১১ টি দেশ ইউরো চালু করেছিল। এখন চালু রয়েছে ১৯টি দেশে।
.
ইউরো চালু হওয়ার সময়ই ইউরো নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তখন বলা হয়েছিল ইউরোপের উত্তরের ধনী দেশগুলো ইউরো চালু হলে এ থেকে সুবিধা নিতে পারে। আজ এতবছর পর এই আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হলো। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও, তিন বছর পর্যন্ত নিজ নিজ দেশের মুদ্রা চালু থাকে এবং ২০০২ সালের জুলাই মাসে ইউরোর কাগজী ও ধাতব মুদ্রা চালু হওয়ার পর পুরনো মুদ্রা বাতিল হয়ে যায়। গত ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ইইউ এর কয়েকটি দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। দেশগুলো ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকটা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে গ্রীস, ইতালি, স্পেন ও পর্তুগালের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এই দেশগুলো অতিরি্ক্ত ঋণ নিয়েও পরিস্থিতি পুরোপুরি সামাল দিতে পারছে না।
.
শুরু থেকেই নানা সংকটে জর্জরিত ইইউর অর্থনৈতিক সংকট এখন সব সমস্যাকে টপকে গিয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ঋণ সংকটে জর্জরিত ইউরোপে গ্রিসের মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবার বড় ধরনের মন্দার দুর্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে গত বছরই যেখানে ইউরো ব্যবহারকারী এ অঞ্চলের প্রবৃদ্ধির অঙ্ক ছিল শূন্যের কোটায়, সেখানে নতুন করে আশার বাণী শোনানোর সুযোগ খুবই কম। প্রবৃদ্ধির এ শূন্যতা একাধারে একক মুদ্রা চালু রাখা যাবে কিনা— এ প্রশ্ন যেমন উত্থাপন করেছে, তেমনি সম্পূরক প্রশ্ন হতে পারে সংস্থাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে। পাশাপাশি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলো গ্রিসের মতো ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর বাজার ব্যবস্থাকে গ্রাস করছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে কয়েক দফা।
গ্রিসের ঋণ সংকট ইইউর ভবিষ্যেক যাতে বিপন্ন না করতে পারে এ উদ্দেশ্যে বিশেষজ্ঞরা অনেক বিকল্প পথের চিন্তা শুরু করেছেন এরই মধ্যে। তারা সম্পূরক ঋণ প্রদানের মাধ্যমে গ্রিসের দেউলিয়াত্ব প্রতিরোধের পক্ষে যেমন কথা বলেছেন, তেমনি অনেকের প্রস্তাবনা অর্থনীতি প্রশ্নে দ্বিস্তরী ধারার প্রবর্তন করার। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দুই স্তরবিশিষ্ট ইইউ চেয়ে বসেছে এরই মধ্যে। ইইউ ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি, সেটাই যখন বড় সংকট, তার থেকে উত্তরণে আগে মনোযোগ দেয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য একক মুদ্রা প্রচলিত হলেও তার সঙ্গে ক্রয়ক্ষমতা, বিনিয়োগ, অর্থনীতির আকার, পিপিপি তথা পার্চেজিং পাওয়ার প্যারিটি এবং আরো আনুষঙ্গিকতাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করার কথা বেশ জোরেশোরেই বলা হচ্ছে এখন। তবে ইউরোপে সৃষ্ট এ অর্থনৈতিক মন্দা থেকে আশু উত্তরণের আশা করছেন না বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ।
.
=======================
★ গ্রিস সংকট সমাধানে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ
=======================
ক. গণভোটের আয়াজন :
গ্রীসের অর্থনীতি রক্ষায় (বেইল আউট ) ঋণদাতা গোষ্ঠীর প্রস্তাব গ্রীস গ্রহণ করবে কি করবে না এই প্রশ্নে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস এই গণভোটের আয়োজন করেছিলেন।সিপ্রাস গ্রিক জনগণকে ‘না’ভোট প্রদানে উৎসাহিত করেছিলেন। বিশ্লেষকদের ধারণা, এতে করে তিনি ঋণদাতাদের বলতে পারবেন, আমার পেছনে গ্রিসের জনগণ আছে। এবার আপনাদের নতুন কোনো শর্ত খোঁজা উচিত। গণভোটের ফলাফলে দেখা যায় প্রস্তাবের পক্ষে (অর্থাৎ ঋণদাতা গোষ্ঠীর কঠিন শর্তের পক্ষে) ভোট পড়েছে শতকরা ৩৮.৬৯ ভাগ, অন্যদিকে প্রস্তাবের বিপক্ষে (অর্থাৎ ঋণদাতা গোষ্ঠীর শর্ত প্রত্যাখ্যান) ভোট পড়েছে শতকরা ৬১.৩১ ভাগ।
.
সিপ্রাস গণভোটের আয়াজন করে একটি ঝুঁকি নিয়েছিলেন, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্ত তিনি যে বিষয়টিকে জনগনের কাছে বেশি করে উপস্থাপন করেছিলেন তা হচ্ছে গ্রীক কী ‘ট্রয়কা’ এর কাছে আত্মসমর্পণ করবে, নাকি একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে টিকে থাকবে? গ্রিক জনগণ একটি নতুন নেতৃত্বই চেয়েছিল। সিপ্রাস হচ্ছেন তাদেরেই প্রতিনিধি। তিনি আইএমএফ’র ফাঁদে ধরা দিতে চাননি। তিনি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছেন। তাদের কিছু শর্ত মেনেছেন। কিন্ত তাতে গ্রীসের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসেনি। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক কাঠামোগত সামঞ্জস্য এর আওতায় ঋণ দেয়। এটা শর্তযুক্ত ঋণ এবং ঋণগ্রহীতা দেশকে তা মানতে হয়। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো (১৯৯১ পরবর্তী) এই কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় (বাংলাদেশও) ঋণ পেয়ে থাকে। একই নিয়মে উন্নয়নশীল বিশ্বও ঋণ পাচ্ছে।
.
খ. অর্থনৈতিক সংস্কার প্রস্তাব পার্লামেন্টে পাস :
অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টায় আরো এক ধাপ এগোলো গ্রিস। ইউরোজোনের কাছে জমা দেওয়া বেইল-আউটের অর্থছাড় করানোর অর্থনৈতিক সংস্কার প্রস্তাব দেশটির পার্লামেন্টে পাস হয়েছে। শেষ পর্যন্ত গিসের পার্লামেন্ট সংস্কার প্রস্তাবের পক্ষেই মত দিলো। বিলটি পাস হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপরাস বলেন, ঋণদাতাদের সঙ্গে দরকষাকষি করার পক্ষে জনগণের ম্যান্ডেট রয়েছে। সে হিসেবে, গ্রিকবাসীর কথা মাথায় রেখে অর্থনৈতিক সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
.
গ. গ্রিস সংকট নিয়ে কী সমাধানে পৌঁছেছে ইউরোজোন :
গ্রিস সংকট নিয়ে অবশেষে সমাধান মিলেছে। গ্রিসের জন্য তৃতীয় আর্থিক পুনরুদ্ধার (বেলআউট) নিয়ে টানা আলোচনার পর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ইউরোজোনের নেতারা ‘সর্বসম্মত’ভাবে একটি সমাধানে পৌঁছেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক বলেন, একটি আর্থিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা গ্রিসের জন্য ‘প্রস্তুত’ আছে। এতে ‘গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন ও আর্থিক সহায়তা’ থাকবে। সমাধান এগিয়ে নিতে ইউরোগ্রুপ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কাজ করবে। গ্রিসের জন্য অনুমোদন করা পরিকল্পনার বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করা হয়নি। তবে ডোনাল্ড টাস্ক বলেন, এখন ইউরোজোনের অর্থমন্ত্রীরা স্বল্প মেয়াদে গ্রিসকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করবেন। ইউরোজোনের নেতারা কোনো সমাধানে পৌঁছাতে না পারলে গ্রিসের ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। এ ছাড়া দেশটির মুদ্রা হিসেবেও ইউরো বন্ধ হয়ে যেত।
.

.

No comments:

Post a Comment